৫. সন্ত্রাস
সন্ত্রাস কী?
সন্ত্রাসের মূল কথা হলো বল প্রয়োগের মাধ্যমে ভীতি প্রদর্শন করে কোনো উদ্দেশ্যসাধন বা কার্যোদ্ধারের চেষ্টা করা । এটা যেমন দৃষ্কৃতকারীরা বা সমাজবিরোধীরা করতে পারে, তেমনি সমগ্র রাষ্ট্রে তথা সমগ্ৰ বিশ্বের পটভূমিতেও এমন চেষ্টা হতে পারে। সন্ত্রাস সমাজে যুগ যুগ ধরে চলছে। সন্ত্রাসের প্রধান উৎসগুলো নিম্নে উল্লেখ করা হলো ।
♦ কোনো লক্ষ্য অর্জনে সহিংস কর্মপন্থা গ্রহণ।
♦ বঞ্চিত শ্রেণির মানবাধিকার রক্ষার নামে সহিংস এবং অন্যান্য চরমপন্থী কর্মকাণ্ড পরিচালনা ।
♦ সহিংসতার লক্ষ্যে নিরীহ মানুষের জীবন ও সম্পত্তির ক্ষতিসাধন অথবা রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানকে আক্রমণের লক্ষ্য হিসেবে প্রতিষ্ঠা করা ।
♦ অধিকার আদায়ে আইনগত বিধান ও শান্তিপূর্ণ সমাধানের উপায় থাকা সত্ত্বেও সহিংস কর্মপন্থা ব্যবহার করা ।
সন্ত্রাসের ধরন:
অপরাধী চক্রের দ্বারা সংগঠিত সন্ত্রাস:
অপরাধী চক্র সংগঠিতভাবে সন্ত্রাস চালায় । এদের এক শীর্ষ নেতা থাকে, যে লোকচক্ষুর আড়ালে থেকে নিজের নিয়োজিত লোক দ্বারা ভীতি প্রদর্শন, চাঁদাবাজি, খুন ইত্যাদি কর্মকাণ্ড করে থাকে। এরা নানাভাবে মানুষের মনে আতঙ্ক সৃষ্টি করে।
রাজনৈতিক সন্ত্রাস:
কোনো কোনো রাজনৈতিক দল, সংগঠন বা গোষ্ঠীবিশেষ রাজনীতির নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালায়। ধর্মের নামেও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড চালিয়ে যেতে দেখা যায়। শ্রেণি-সংগ্রামের নামেও কোনো কোনো দল বা সংগঠন সহিংস তৎপরতায় লিপ্ত হয়। কখনো কখনো রাজনৈতিক কর্মসূচীর নামে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড পরিচালিত হতে দেখা যায় ।
আদর্শভিত্তিক সন্ত্রাস:
কোনো গোষ্ঠী তাদের সুনির্দিষ্ট আদর্শ প্রতিষ্ঠার লক্ষ্যে সন্ত্রাসের পথ বেছে নিতে পারে । একসময় শ্রেণি- শত্রু খতমের নামে আমাদের দেশে অনেক রাজনৈতিক হত্যা হয়েছে। রাজনৈতিক উদ্দেশ্যে ধর্মকে ব্যবহার করে ধর্মীয় জঙ্গিগোষ্ঠীগুলো সহিংস পন্থায় সাধারণ মানুষ হত্যা ও রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানের ক্ষতি সাধন করে থাকে ।
রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস:
অনেক সময় রাষ্ট্র নানা অজুহাতে সন্ত্রাসী পন্থা অবলম্বন করে প্রতিষ্ঠান বা জনগোষ্ঠীর উপর দমন-পীড়ন চালায় । এরূপ অবস্থা হলো রাষ্ট্রীয় সন্ত্রাস । যেমন : ইসরাইল রাষ্ট্র প্যালেস্টাইনের জনগণের উপর বিভিন্ন সময় এ ধরনের তৎপরতা চালিয়ে আসছে । রাষ্ট্রের অভ্যন্তরস্থ সংখ্যালঘু বা ভিন্ন জনগোষ্ঠীর উপরও এরূপ আক্রমণ পরিচালিত হতে দেখা যায় ।
সন্ত্রাসের কারণ: সন্ত্রাস দুটি কারণে সংঘটিত হয়, ক) সাধারণ কারণ, খ) বহিঃস্থ কারণ ।
ক) সাধারণ কারণ :
১. অর্থনৈতিক বৈষম্য: কোনো সমাজে সম্পদের অসম বণ্টন থাকলে একশ্রেণির লোক অধিক ধনী হয় এবং অন্য শ্রেণি অধিকতর দরিদ্র হয় । এ অবস্থা বঞ্চিতদের মনে ক্ষোভের সৃষ্টি করে। এছাড়া বেকারত্ব আমাদের দেশে একটি সামাজিক ব্যাধি । যার নেতিবাচক প্রভাব পড়ে সমাজের কর্মক্ষম যুবসমাজের উপর। এর ফলে যুবসমাজ অনৈতিক সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে জড়িয়ে নিজেদের ভাগ্য নির্মাণে আর্থিকভাবে স্বাবলম্বী হতে উদ্বুদ্ধ হয় ।
২. সংকীর্ণ রাজনৈতিক সংস্কৃতি: একটি দেশের রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে যদি রাজনীতি হয় ব্যক্তিস্বার্থ ও দলীয় স্বার্থ উদ্ধারের হাতিয়ার, তাহলে সেই রাজনৈতিক সংস্কৃতিতে সন্ত্রাসের জন্ম অস্বাভাবিক নয় । কারণ, ব্যক্তিস্বার্থ আদায়ের জন্যই সন্ত্রাসীদেরকে লালন-পালন করতে হয় ।
৩. সুশাসনের অভাব: অপরাধীকে খুঁজে বের করে শাস্তি প্রদানের ব্যবস্থা করা আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী ও প্রশাসনের দায়িত্ব । কিন্তু প্রশাসনিক দুর্বলতা এবং রাজনৈতিক চাপের কারণে প্রশাসন অনেক সময় নীরব ভূমিকা পালন করে । এছাড়া আইন প্রয়োগকারী সংস্থার কাঠামোগত দুর্বলতা রয়েছে। যেমন : দুর্বল প্রশিক্ষণ, পুরনো অস্ত্র, পুলিশ ও জনসংখ্যার ভারসাম্যহীন অনুপাত ও আধুনিক নিরাপত্তা সরঞ্জামের স্বল্পতা সন্ত্রাস দমনে আইন- প্রয়োগকারী সংস্থার ভূমিকাকে দুর্বল করে। এসব কারণে অনেক দুর্বল সন্ত্রাসীরাও শক্তি প্রদর্শনে সক্ষম হয় । তাছাড়া উন্নত প্রশিক্ষণ না পাওয়ার কারণে অনেক সময় বিদ্যমান গোয়েন্দা সংস্থাগুলো দ্বারা সমকালীন সন্ত্রাসবাদ মোকাবেলা করা সম্ভব হয় না ।
খ) বহিঃস্থ কারণ:
সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে যেমন অভ্যন্তরীণ ঘটনাপ্রবাহ কাজ করে, তেমনি এর পিছনে বাইরের প্রভাবও থাকতে পারে । অবৈধ অস্ত্রের যোগান, অবৈধ অস্ত্রের সহজলভ্যতা ও সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের পিছনে কাজ করে বলে ধারণা করা হয় ।
সন্ত্রাস প্রতিরোধ ও প্রতিকারের উপায়
বাংলাদেশে সন্ত্রাস একটি সামাজিক ব্যাধি। একে যেমন প্রতিরোধ করা যায়, তেমনি নিরাময়ও করা যেতে পারে । সন্ত্রাস যাতে জন্ম নিতে না পারে এবং সন্ত্রাসীরা যাতে নাগরিকদের জানমালের নিরাপত্তা বিঘ্নিত করতে না পারে সে জন্য নিম্নোক্ত ব্যবস্থাদি গ্রহণ করা আবশ্যক ।
১. সন্ত্রাসবিরোধী আইনের প্রয়োগ : সন্ত্রাস দমনের লক্ষ্যে সন্ত্রাসীদের বিরুদ্ধে যথাযথভাবে আইন প্রয়োগ করতে হবে। রাজনৈতিক বা অন্য যেকোনো উদ্দেশ্যে সংঘটিত সন্ত্রাস দমনের জন্য চরম শাস্তিমূলক ব্যবস্থা গ্রহণ করা হলে দেশে সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ড কমে আসবে।
২. পুলিশ প্রশাসনের পুনর্গঠন : সন্ত্রাস প্রতিরোধের জন্য পুলিশ বাহিনীকে আধুনিক অস্ত্রে ও যন্ত্রপাতিতে সজ্জিত করতে হবে এবং যুগোপযোগী প্রশিক্ষণ দিতে হবে। তাছাড়া আমাদের দেশে পুলিশ ও জনসংখ্যার অনুপাতে ব্যাপক ব্যবধান বিদ্যমান। এখানে প্রায় ৮০০ মানুষের জন্য একজন পুলিশ সদস্য। এ অবস্থার নিরসন হওয়া বাঞ্ছনীয়। পুলিশের সংখ্যা, পুলিশ ফাঁড়ি, থানার সংখ্যা বৃদ্ধি করা প্রয়োজন ।
৩. কর্মসংস্থান বৃদ্ধি ও বেকার ভাতা প্রদান: দেশে কুটির শিল্প, বৃহদায়তন শিল্প ও কলকারখানা স্থাপন, সকল ক্ষেত্রে শূন্যপদ পূরণ ও নতুন নতুন কর্মক্ষেত্র তৈরি করতে হবে। বেকারত্ব দূরীকরণ সম্ভব হলে সন্ত্রাসী কর্মতৎপরতা অনেকাংশে হ্রাস পাবে। বেকারত্ব দূরীকরণের জন্য অগ্রসর দেশের মতো না হলেও ন্যূনতম জীবনমান বজায় রাখার মতো বেকার ভাতা দেওয়ার ব্যবস্থা করা দরকার । সামাজিক নিরাপত্তা হিসেবে বেকার ভাতা উত্তম ব্যবস্থা ।
৪. সর্বজনীন শিক্ষা ও মূল্যবোধের জাগরণ : সবার জন্য শিক্ষার সুযোগের মাধ্যমে নাগরিকদের মধ্যে সামাজিক ও নৈতিক বোধ জাগ্রত করতে হবে। এ উদ্দেশ্যে বিদ্যালয় এবং বিভিন্ন শিক্ষা কর্মসূচিতে নৈতিক শিক্ষার ব্যবস্থা করা যায় । এতে সন্ত্রাসমূলক কার্যকলাপ প্রতিরোধ ও প্রতিকার সম্ভব হবে ।
৫. রাজনৈতিক দলে সন্ত্রাসীদের আশ্রয় না দেওয়া : রাজনৈতিক দলে কোনো সন্ত্রাসীকে আশ্রয় দেওয়া যাবে না । কোনো দল সন্ত্রাসীদের মদদ দিলে বা আশ্রয় দিলে সে দলের রেজিস্ট্রেশন বাতিল করতে হবে । এমন দলের কোনো সদস্যকে নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে দেওয়া হবে না, এ মর্মে সংসদে আইন তৈরি করতে পারে ।
৬. প্রশাসনিক কঠোরতা : সন্ত্রাস দমন, ঘুষ ও দুর্নীতি বন্ধ, স্বজনপ্রীতি রোধ এবং কঠোর প্রশাসনিক পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে । স্বাধীন ও নিরপেক্ষভাবে পুলিশ প্রশাসন ও সাধারণ প্রশাসন যাতে কাজ করতে পারে তা নিশ্চিত করতে হবে ।
৭. গণসচেতনতা : জনগণের সচেতন প্রতিরোধ সন্ত্রাস দমনে খুবই কার্যকর ভূমিকা রাখতে পারে । জনগণ সচেতনভাবে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সোচ্চার ও সংঘবদ্ধ হলে সন্ত্রাস বহুলাংশে হ্রাস পাবে ।
নাগরিক হিসেবে আমাদের করণীয়:
নাগরিক হিসেবে আমরা সন্ত্রাসী তৎপরতা সম্পর্কে সচেতন থাকব। সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডের খারাপ দিকগুলো সম্পর্কেও আমরা জানব । সন্ত্রাসী তৎপরতা রোধে আমরা আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীকে সহায়তা করব । সামাজিক ও ধর্মীয় মূল্যবোধ মেনে চলব ।
আরও দেখুন...